১৫৮২ সালের অক্টোবরের ক্যালেন্ডার রহস্য: ১০ দিন হারিয়ে যাওয়ার গল্প

১৫৮২ সালের অক্টোবরের ক্যালেন্ডার রহস্য: ১০ দিন হারিয়ে যাওয়ার গল্প

ইতিহাসের পাতায় ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাসটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই মাসে, পৃথিবী জুড়ে সময়ের গণনা ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তন কেবলমাত্র একটি নতুন ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং, প্রাচীন ক্যালেন্ডারের একটি ভুল সংশোধনের জন্য প্রায় দশটি দিন সরাসরি বাদ দেওয়া হয়। এই ঘটনা একসময় “ক্যালেন্ডারের রহস্য” বা “হারানো দশদিন” নামে পরিচিতি লাভ করে। আসুন, এ রহস্যময় মাসটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।



জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এবং তার সমস্যা


পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার জুলিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। এই ক্যালেন্ডারে প্রতি বছর ৩৬৫.২৫ দিনের সমান সময় হিসেবে ধরা হতো, অর্থাৎ প্রতি চার বছরে একবার করে লিপ ইয়ার যোগ করা হতো। প্রথমদিকে এই ক্যালেন্ডার সঠিক মনে হলেও, সময়ের সাথে সাথে এটিতে একটি ছোট্ট ত্রুটি দেখা দেয়। মূলত একটি সৌর বছর ৩৬৫.২৪২২ দিন দীর্ঘ, যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসাবের সাথে মেলে না। ফলে, প্রতি ১২৮ বছরে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সৌর বছরের গড় সময়ের প্রায় একদিনের পার্থক্য তৈরি হচ্ছিল।


কেন এই সমস্যার সমাধান প্রয়োজন ছিল?


এই ত্রুটির কারণে, ১৫৮২ সালের মধ্যে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ও প্রকৃত সৌর বছরের মধ্যে প্রায় ১০ দিনের ব্যবধান তৈরি হয়। এর ফলে বসন্ত বিষুব (Vernal Equinox), যা ঐতিহ্যগতভাবে ২১ মার্চে পালিত হতো, তা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছিল এবং খ্রিস্টীয় উৎসবগুলো নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছিল না। তাই পোপ গ্রেগরি XIII এই সমস্যার সমাধান করতে উদ্যোগী হন।


গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন


পোপ গ্রেগরি XIII নতুন ক্যালেন্ডার, যা "গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার" নামে পরিচিত, ১৫৮২ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে কার্যকর করার নির্দেশ দেন। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সমন্বয়ের জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়। পুরনো এবং নতুন সময়ের ব্যবধান দূর করতে, ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাসে ১০ দিন সরাসরি বাদ দেওয়া হয়। ৪ অক্টোবরের পরপরই ১৫ অক্টোবর শুরু হয়, অর্থাৎ ৫ থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত কোনো দিন ছিল না।


এই পরিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয় "হারানো ১০ দিন"


১৫৮২ সালের অক্টোবরের এই ক্যালেন্ডার পরিবর্তন অনেকের জন্য বিস্ময়কর ও রহস্যময় ছিল। মানুষ হঠাৎ করেই ১০ দিন হারিয়ে ফেলল! তখনকার সাধারণ মানুষের কাছে এই সিদ্ধান্ত কিছুটা বিভ্রান্তিকর মনে হলেও, পোপ গ্রেগরি XIII এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন।


গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার এবং এর বৈশিষ্ট্য


গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বৈশিষ্ট্য হলো এটি সৌর বছরের সাথে আরও সঠিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই ক্যালেন্ডার লিপ ইয়ারকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য একটি নতুন নিয়ম প্রবর্তন করে। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি ৪০০ বছরে ৩টি লিপ ইয়ার বাদ দেওয়া হবে। যেমন, শতাব্দীর বছরগুলো লিপ ইয়ার হবে না যদি না সেই বছরগুলো ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য হয় (যেমন, ১৬০০ এবং ২০০০ সাল লিপ ইয়ার, কিন্তু ১৭০০, ১৮০০ এবং ১৯০০ সাল নয়)।


গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের প্রতিক্রিয়া


প্রথমে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার শুধুমাত্র ক্যাথলিক দেশগুলোতে গ্রহণ করা হয়, যেমন স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি, এবং পোল্যান্ড। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট দেশগুলো, যেমন ইংল্যান্ড, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করতে অনেকটা দ্বিধা করেছিল এবং কয়েক দশক পরে ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করে। অনেক দেশে এই ক্যালেন্ডার ধীরে ধীরে গৃহীত হয়, এবং কিছু দেশে তা গ্রহণে প্রায় কয়েকশো বছর লেগে যায়। রাশিয়া ও গ্রিসের মতো কিছু দেশ তো ২০শ শতক পর্যন্ত এই ক্যালেন্ডার গ্রহণ করেনি।


আজকের দিনে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার


বর্তমানে, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই মান্য। এটি আন্তর্জাতিক মানের ক্যালেন্ডার হিসেবে গৃহীত হয়েছে এবং সময় গণনার ক্ষেত্রে এটিই সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়।



উপসংহার


১৫৮২ সালের অক্টোবর মাসের এই ক্যালেন্ডার পরিবর্তনের ঘটনা কেবলমাত্র একটি তারিখ পরিবর্তন নয়, বরং এটি ছিল একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন যা পুরো বিশ্বের সময় গণনায় একটি যুগান্তকারী প্রভাব ফেলেছিল। "হারানো ১০ দিন" এর রহস্যময়তার পেছনে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক এবং ধর্মীয় হিসাব, যা আমাদের আজকের সময়ের ধারনার ভিত্তি স্থাপন করেছে।


Post a Comment

Join the conversation